বিশ্ব যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবস সম্পর্কে কিছু কথা।
আজ ৪ ঠা মার্চ, বিশ্ব যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবস। যদিও দিবসটি ঘিরে সরকারি–বেসরকারিভাবে দেশের কোথাও কোনো উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় না। বিশ্ব যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবসটিকে গুরুত্ব দিয়ে নানা ধরণের সচেতনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করলে এ ধরণের অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হতো।
যৌন হয়রানি নারীর ক্ষমতায়নে অন্যতম অন্তরায়। ঘরে–বাইরে সর্বত্র নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাচ্ছে না এ ব্যাধির হাত থেকে। নারীদের অবাধ বিচরণ হলেও তারা বিভিন্ন স্থানে যেমনঃ– বাড়ি, রাস্তাঘাট, যানবাহন, ফুটপাত কিংবা জনসমাগম হয় এমন স্থানগুলোতে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীই উল্টো সামাজিকতার ভয়ে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। এ ঘটনার শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদ্যসের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়, তাদের জীবনে নেমে আসে দুবির্ষহ পরিস্থিতি। প্রতিবাদ করলে উল্টো হামলার শিকার হতে হয়, তাই অনেক নিরুপায় অভিভাবক বখাটেদের ভয়ে সন্তানের স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে গৃহবন্ধী করে রাখে। বখাটেদের উৎপাতে শৈশব- কৈশোর গৃহবন্ধী অবস্থায় কাটায় অনেক মেয়ে। একইভাবে কর্মস্থলে যৌন হয়রানির কারণে অনেক নারী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয় এবং অনেক অভিভাবক মেয়েদের চাকরি করাতে চায় না। সামাজিক ও পারিবারিকসহ নানান ভয়ে এ ধরণের হয়রানির বিষয়টি গোপন রাখে নারী। বিচারহীনতার প্রবণতায় যৌন হয়রানির মতো মারাত্নক অপরাধ বেড়েই চলেছে দিন দিন।
বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে অহরহ। ২০১৮ সালে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, গণপরিবহণে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো ভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আরো হয়রানির আশঙ্কায় নারীরা প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়। যৌন নিপীড়ন বন্ধে সরকারি নানবিধ উদ্যোগ থাকলেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখছে না।
ব্র্যাকের এক জরিপের তথ্যানুসারে, হেনস্থাকারীদের অধিকাংশই মধ্যবয়সী বা বয়স্ক পুরুষ (৪১ থেকে ৬০ বছর)
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার উপ-পরিষদের এক জরিপে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার। এ হার ৫৩ শতাংশেরও বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৭ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ এবং মেডিকেল কলেজে ৫৪ শতাংশ ছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হয়। এর বাইরেও বিভিন্ন পেশায় জড়িত ১৯ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার। এছাড়াও বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।
দেশে যৌন হয়রানি রোধে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যতটা উদ্যোগ নেওয়া দরকার তা হয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে স্কুল, কলেজে অনেক যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলেও তা প্রকাশ পায় না। স্কুল-কলেজের গর্ভনিং বডি ধামাচাপা দেয়। কেউ অভিযোগ করলে উল্টো হেনস্তার শিকার হতে হয়। ঢাকাসহ বাংলাদেশের কোনো স্কুল-কলেজেই যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি নেই।
বাংলাদেশ ২০১০ সালে উচ্চ আদালত যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে একটি নিদের্শনা দেয়। তাতে বলা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে নারী রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে একজন নারীর নেতৃত্বে যৌন নিপীড়ন বিরোধী কমিটি থাকতে হবে। কমিটিতে নারীদের প্রাধান্য থাকতে হবে। একটি বাক্সে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি তিন মাস পর ওই বাক্স খুলে যদি কোন অভিযোগ পান তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে কমিটি। তদন্তর নিরপেক্ষ ফল পেতে গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। কেউ চাইলে সারাসরি কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। কিন্তু হাইকোর্টের নিদের্শনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কিছু প্রতিষ্ঠানে এ ধরণের কমিটি থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই নেই।
যৌন নিপীড়ন বলতে কি বোঝায় তা স্পষ্ট নয়, সবার ধারণা শুধু ধর্ষণকে যৌন নিপীড়ন বলে। ২০০৩ সালের আইনে অসৎ উদ্দেশ্যে নারীর যেকোনো অঙ্গ স্পর্শ করাই যৌন নিপীড়ন। এমনকি অশালীন মন্তব্য, নারীর পোশাক ধরে ঢান দেওয়া, ধাক্কা দেয়াও যৌন নিপীড়ন এর মধ্যে পড়ে। এই অপরাধে নিপীড়ককে চিহ্নিত করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বয়কট এবং আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হব। ধর্ষণের শিকার নারীকে দায়ী না করে তার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে তার পাশে দাঁড়াতে হবে।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের দিকে। একটি দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী হল নারী সমাজ। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতা নিশ্চিত না হলে একটি দেশের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখা যায় না। সময়ের ব্যবধানে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছে নারীসমাজ। ভুক্তভোগীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সরকারি এবং ব্যক্তিগত ভাবে যৌন হয়রানি বন্ধে সংশ্লিষ্টদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। যৌন হয়রানি নির্মূলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। যৌন নিপীড়নে জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হলে সমাজ থেকে এ ধরণের অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব।
যৌন হয়রানি রোধে করণীয়ঃ-
· রাস্তাঘাটে বা যানবাহনে হেনস্থা বা যৌন হয়রানির শিকার হলে তাৎক্ষণিক সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে যাতে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়।
· যদি কোন নির্জন স্থানে ঘটে তাহলে নারীকে নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে এবং কৌশলে নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করতে হবে।
· যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে কন্যা সন্তানকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্ত করে গড়ে তোলার বিষয়ে পরিবারকে সচেতন হতে হবে।
· যতদ্রুত সম্ভব পুলিশের শরণাপন্ন হতে হবে।
No comments